মানুষের পেছনে লেগে এ দায়িত্বই পালন করে শয়তান। মানুষকে তার দায়িত্ব ও
কর্তব্য পালনের সহজ-সরল-সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত করে তার প্রকৃত
মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে তাকে নিচে নামিয়ে দেয়াই শয়তানের
প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। এরি জন্যে সে মরিয়া হয়ে কাজ করে। এটাই তার জীবনের
একমাত্র প্রতিজ্ঞা, একমাত্র অংগিকার।
কিন্তু মানুষ তার এই স্বঘোষিত সুস্পষ্ট শত্রুর বিষয়ে অচেতন, অসতর্ক ও গাফিল। যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা নবী রসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে শয়তান সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন।
ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ
‘তারপর আমি তাকে নামিয়ে দিই নিচুদের চাইতেও নিচে।’ (সূরা আত তীন : ৫)
শয়তানের পদাংক অনুসরণ না করতে, তার আনুগত্য ও দাসত্ব না করতে :
يَا بَنِي آدَمَ لاَ يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
অর্থ : হে আদম সন্তানেরা (সতর্ক হও)! শয়তান যেনো ধোকা প্রতারণার (ফবপবরাব) মাধ্যমে তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন থেকে বিচ্যুত করে) ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, যেভাবে সে (ধোকা প্রতারণার মাধ্যমে) তোমাদের (আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল। তাদের পরস্পরকে তাদের গোপন অংগ দেখানোর জন্যে সে তাদের বিবস্ত্র করে দিয়েছিল। সে এবং তার দলবল এমনভাবে (বা এমন স্থান থেকে) তোমাদের দেখতে পায় যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাওনা। আমি শয়তানগুলোকে সেই সব লোকদের অলি (অভিভাবক) বানিয়ে দিয়েছি, যারা ঈমান আনেনা, ঈমানের পথে চলেনা। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ২৭)
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
অর্থ : তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই সে তোমাদের ডাহা দুশমন। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ১৬৮)
وَلَا يَصُدَّنَّكُمُ الشَّيْطَانُ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
অর্থ : (হে মানুষ!) শয়তান যেনো (সত্য-সঠিক-সরল পথে চলতে) তোমাদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে না পারে। জেনে রাখো, সে তোমাদের সুস্পষ্ট শত্রু। (সূরা ৪৩ যুখরুফ : আয়াত ৬২)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا ۖ وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ
عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
অর্থ : হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা হক (সত্য); সুতরাং এই পৃথিবীর জীবন যেনো কিছুতেই তোমাদের প্রলুব্ধ ও প্রতারিত না করে এবং সেই মহা প্রতারক (শয়তান)ও যেনো আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোকায় না ফেলে। শয়তান তো তোমাদের ডাহা শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারীদের (এমন সব কাজের) আহবান জানায়, যাতে তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়ে যায়। (সূরা ৩৫ ফাতির : আয়াত ৫-৬)
মহান আল্লাহ এসব অকাট্য ও বিবেক জাগ্রতকারী সতর্কবাণী দ্বারা কি মানুষ শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেনা?
২.শয়তান আল্লাহর অবাধ্য, মানুষের চরম দুশমন এবং মহাপ্রতারক
শয়তান সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। কারণ যে ব্যক্তি শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেনা, সে সহজেই শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। দেখুন শয়তান সম্পর্কে মহান আল্লাহ কী বলেন :
১. শয়তান আল্লাহর চরম অবাধ্য : إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَـٰنِ عَصِيًّا ‘শয়তান দয়াময় রহমানের চরম অবাধ্য-নাফরমান।’ (সূরা মরিয়ম : আ. ৪৪)
২.শয়তান আল্লাহর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا ‘শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)
৩.শয়তান মানুষের স্বঘোষিত সুস্পষ্ট দুশমন : ِاِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ ‘নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের সুস্পষ্ট শত্রু।’ (সূরা ১২ ইউসুফ : আয়াত ৫)
৪.শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًا ‘অবশ্যি শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক, মহা ধোকাবাজ।’ (সূরা ২৫: ২৯)
৫.শয়তান মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায় : إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ
‘এ হলো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়।’ (সূরা ৩ : ১৭৫)
৬.শয়তানের সংকল্প মানুষকে চরম বিপথগামী করা : وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا : ‘শয়তান তাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে বহুদূর নিয়ে যেতে চায়।’ (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৬০)
৭.মানুষের সামনে শয়তানের সব প্রতিশ্রুতিই প্রতারণা : وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا : ‘শয়তানের সমস্ত ওয়াদাই প্রতারণা আর ধোকাবাজি।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৪)
৮.শয়তান মহাপ্রতারক : وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغُرُوْرَ ‘মহাপ্রতারক যেনো আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে। (সূরা লোকমান : ৩৩ ; সূরা ফাতির : ৫)
৩. শয়তানের পরিচয়
আরবি ভাষায় শয়তান (شَيْطَانٌ) মানে- সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বৈরাচারি।১ এই বৈশিষ্ট্যের জিন এবং মানুষ উভয়ের জন্যেই শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কুরআন মজিদে উভয়ের জন্যে শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধাচারী নেতাদের শয়তান বলা হয়েছে। شَيْطَانٌ-এর বহুবচন شَيَاطِيْنٌ। শয়তান শব্দটি একটি পরিভাষা হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই সকল ধর্মের লোকদের কাছে একটি সুপরিচিত শব্দ। এ শয়তান জিনদের অন্তরভুক্ত২। শয়তান কথাটি সর্বপ্রথম সেই জিনটির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যে আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস্ সালামকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কুরআন মজিদে শয়তান শব্দটি একবচন ও বহুবচনে ৮৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
শয়তানকে কুরআন মজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে।৩ بَلَسٌ ও اِبْلاَسٌ শব্দমূল থেকে اِبْلِيْسٌ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া, ভয়ে ও আতংকে নিথর হয়ে যাওয়া, দু:খে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া, সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশা ও ব্যর্থতার ফলে মরিয়া (desperate) হয়ে উঠা।
শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার আহত অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মরণ খেলায় নেমে সব ধরণের অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হয়।৪ কুরআন মজিদে ইবলিস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১১ বার।
শয়তানকে কুরআন মজিদে খান্নাসও বলা হয়েছে।৫ خَنَّاسٌ শব্দটি خُنُوْسٌ শব্দমূল থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ- সামনে এসে আবার পিছিয়ে যাওয়া, প্রকাশ হয়ে আবার গোপন হয়ে যাওয়া। খান্নাস আধিক্যবোধক শব্দ। সুতরাং এর অর্থ বারবার সামনে আসা এবং পিছিয়ে যাওয়া, বারবার প্রকাশ হওয়া এবং গোপন হয়ে যাওয়া।
শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে এ কারণে যে, সে বারবার এসে প্ররোচনা দেয় এবং বারবার পিছিয়ে এবং লুকিয়ে যায়। এভাবে সে প্ররোচনা দিতেই থাকে। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : মানুষ যখন গাফিল ও অসতর্ক-অসচেতন হয়, তখনই শয়তান এসে তাকে প্ররোচনা ও ধোকা দেয়; কিন্তু যখনই সে সতর্ক হয় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান পিছিয়ে যায়, লুকিয়ে যায়। এ কারণেই শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে।৬ কুরআন মজিদে খান্নাস শব্দ ব্যবহার হয়েছে ১ বার।
কুরআন মজিদে শয়তানকে আল গারুর (اَلْغَرُوْرٌ)ও বলা হয়েছে। এর শব্দমূল হলো গরর (غَرَرٌ)। গরর মানে- ধোকা-প্রতারণা। আল গারূর মানে- মহা ধোকাবাজ, মহাপ্রতারক। কুরআন মজিদে ৩ স্থানে শয়তানকে আল গারূর বলা হয়েছে।
৪.শয়তানের পূর্ব ইতিহাস
কুরআন মজিদের সূরা কাহাফের ৫০ (পঞ্চাশ) নম্বর আয়াতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, ইবলিস শয়তান জিন গোত্রীয়। আর জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। সুতরাং শয়তান আগুনের তৈরি জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত।
মুফাস্সির এবং ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারি এবং ইবনে কাছির তাঁদের তফসির এবং ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. , ইবনে মাসউদ রা. এবং তাবেয়ী হাসান বসরি, তাউস, সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব, সা’দ ইবনে মাসউদ, শহর ইবনে হোশেব, কাতাদা প্রমুখ থেকে শয়তান ইবলিসের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত সার হলো :
মানুষের পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো জিন জাতি। তারা ছিলো আগুনের তৈরি এবং দীর্ঘজীবী। একসময় এসে তারা পারস্পারিক বিবাদ বিসম্বাদে পৃথিবীকে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের দুষ্কর্মে ও ফিতনা ফাসাদে ভরে যায় পৃথিবী। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরেশতাদের পাঠান তাদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করতে এবং তাদের বিতাড়িত করতে। ফেরেশতারা এসে জিনদের একদলকে ধ্বংস করে দেন, কিছু জিনকে সমুদ্রের দিকে তাড়িয়ে দেন আর কিছু জিনকে তাড়িয়ে দেন পাহাড় পর্বতের দিকে। এভাবে মহান আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে জিনদের উচ্ছেদ করেন এবং তাদের কর্তৃত্বের ক্ষমতা বিনাশ করে দেন।
এই ফেরেশতাদল পৃথিবী থেকে ফিরে যাবার সময় আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে একটি জিন শিশুকে সাথে করে নিয়ে যায়। তার নাম ছিলো আযাযিল। সে ফেরেশতাদের সাথে বসবাস করতে থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এভাবে সে ফেরেশতাদের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীকালে এই আযাযিলই শয়তান এবং ইবলিস হিসেবে পরিচিত হয়।৭
৫.ইবলিস আল্লাহর হুকুম সত্ত্বেও আদমকে সাজদা করেনি
পৃথিবী থেকে জিনদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করার পর মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন :
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
অর্থ : আমি পৃথিবীতে (নতুন করে) প্রতিনিধি/আরেকটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩০)
অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ একটি নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করার মনস্থ করলেন। এ প্রজাতির নাম দিলেন তিনি ‘মানুষ’।র প্রতিনিধিত্ব করার সব জ্ঞান দান করলেন তিনি আদমকে। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের কর্তৃত্ব পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন ফেরেশতাদের সহযোগিতা। তাই মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের হুকুম করলেন আদমকে সাজদা করতে। অর্থাৎ আদম ও তার সন্তানদের আনুগত্য করার প্রতীকি প্রমাণ পেশ করতে। ফেরেশতারা সবাই আদমকে সাজদা করে। কিন্তু সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায় ইবলিস :
ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْن
অর্থ : অতপর আমরা ফেরেশতাদের বললাম : ‘আদমের উদ্দেশ্যে সাজদা করো।’ তখন সবাই সাজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলোনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১১)
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ
অর্থ : আমরা যখন ফেরেশতাদের আদেশ করলাম : ‘তোমরা সাজদা করো আদমকে।’ তখন সাজদা করলো সবাই; ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ০২ আল বাকরা : আয়াত ৩৪; সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১; সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)
فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلَّا إِبْلِيسَ
অর্থ : তখন সাজদা করলো ফেরেশতারা সকলেই ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩০-৩১; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৩-৭৪)
আল্লাহ ইবলিসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা থেকে বিরত রেখেছে?
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ : সে বললো : আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ১২)
.মহান আল্লাহ ইবলিসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে সহই ফেরেশতাদের সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাইতো সাজদা না করার কারণে তিনি ইবলিসকে প্রশ্ন করলেন :
قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : (হে ইবলিস) আমি নির্দেশ দেয়া সত্তেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা করা থেকে বিরত রেখেছে? (সূরা ৭ আল আরাফ : আয়াত ১২)
قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
অর্থ আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস ! তোমার কী হলো যে, তুমি সাজদা কারীদের অন্তর্ভুক্ত হলেনা? (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩২)
قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ الْعَالِينَ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি , তাকে সাজদা করতে কিসে তোমাকে বাধা দিলো? তুমি কি ঔদ্ধত্য দেখালে, নাকি তুমি উচু মর্যাদার কেউ? (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৫)
এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো, মহান আল্লাহ ইবলিসকে সহই ফেরেশতাদেরকে সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা না হলে ইবলিসের কাছে সাজদা না করার কৈফিয়ত তলব করার কোনো কারণ ছিলনা।
২.দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইবলিসকে সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত প্রমাণ করে, সেটা হলো স্বয়ং ইবলিসের স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি।
অর্থাৎ এ নির্দেশ যে ইবলিসের উপরও বর্তিয়েছিল, সেটা ইবলিস নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিল। সে আল্লাহর কৈফিয়ত তলবের জবাবে একথা বলে নাই যে, নির্দেশ তো আমাকে দেন নাই, দিয়েছেন ফেরেশতাদেরকে।
তাছাড়া নির্দেশ পালনে তার অস্বীকৃতিও প্রমান করে যে, তাকেও সাজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে আল্লাহর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায় এবং যুক্তি প্রদর্শন করে। দেখুন আল্লাহ্র কৈফিয়ত তলবের জবাবে তার বক্তব্য :
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ : সে (জবাবে) বললো : (আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা, কারণ) আমি তার চাইতে উত্তম-শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে। (সূরা ৭ আ’রাফ: আয়াত ১২; সুরা ৩৮ সোয়াদ: আয়াত ৭৬)
قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا ؟
অর্থ : (জবাবে ইবলিস) বললো : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)
قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
অর্থ : সে বললো : গন্ধযুক্ত কাদার ঠনঠনে মাটি দিয়ে আপনি যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৩)
এখন একথা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে গেলো, ইবলিস কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই একেবারে সহজ সরলভাবে বুঝে নিয়েছিল, সেও সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সুতরাং যার ব্যাপারে প্রশ্ন, তারই যখন কোনো প্রশ্ন নেই, তখন আমি আপনি প্রশ্ন তোলার কে?
৭. ইবলিস জেনে বুঝেই আল্লাহর হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে
একথা পরিষ্কার, ইবলিসও সাজদা করার হুকুমের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। জেনে বুঝেই সে আল্লাহর আদেশ পালন করেনি এবং আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তার এই অস্বীকৃতির ধরণ কেমন ছিলো? এ প্রসঙ্গে দেখুন আল্লাহর বাণী :
أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
অর্থ : সে (আল্লাহ্র নির্দেশমতো আদমকে সাজদা করতে) অস্বীকৃতি জানায়, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩৪; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪)
أَبَىٰ أَن يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
অর্থ : সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩১)
كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
অর্থ : সে ছিলো জিন প্রজাতির। সে তার প্রভুর নির্দেশ মান্য করতে অস্বীকার করে এবং সীমালংঘন করে। (সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)
এখানে ইবলিসের সাজদা না করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি, অহংকার-দাম্ভিকতা, কুফুরি এবং সীমালংঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জেনে বুঝে হুকুম অমান্য করার ক্ষেত্রেই এ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৮. শয়তানের গুরুতর অপরাধ সমূহ
আদমকে সাজদা করার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে শয়তান তার মর্যাদার আসনে থেকে এমন সব গুরুতর অপরাধ করে বসলো, যা চরম অমার্জিত ও ক্ষমাহীন। তার সেই গুরুতর অপরাধ সমূহ হলো :
১.সে আল্লাহ্র হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে এবং
২.সে অহংকার, দাম্ভিকতা ও হঠকারীতা প্রদর্শন করে :
أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ
অর্থ : সে আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার (refuse) করে, অহংকার-দাম্ভিকতা-হঠকারিতা প্রদর্শন করে। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)
৩.সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে এবং অবাধ্য হয় :
فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
অর্থ : সে তার প্রভুর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে । (সূরা ১৮ কাহাফ : ৫০)
৪.সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে :
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ
অর্থ : সে বলে : আমি তার (আদমের) চাইতে শ্রেষ্ঠ। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)
৫.সে অনুশোচনা করেনি; বরং নিজের হঠকারিতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে :
قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا
অর্থ : সে বলে : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)
নিজের অবাধ্যতার পক্ষে সে আরো যুক্তি প্রদর্শন করে :
خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ: তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)
قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
অর্থ: সে বলে : মানুষকে সাজদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো শুকনো ঠনঠনে পঁচা মাটি থেকে। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৩)
৬.সে আল্লাহ্র হুকুমের বিপক্ষে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে : আল্লামা ইবনে জারির তাবারি এবং আল্লামা ইবনে কাছির তাঁদের তফসিরে উল্লেখ করেছেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী মুফাস্সির হাসান বসরি রহ. বলেছেন :
قَاسَ اِبْلِيْسُ وَهُوَ اَوَّلَ مَنْ قَاسَ
অর্থ: ইবলিস তার যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে (নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে) এবং ইবলিসই সর্বপ্রথম দলিল (evidence)-এর বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে।
প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে সীরিন বলেন :
اَوَّلَ مَنْ قَاسَ اِبْلِيْسُ وَمَا عَبَدَتِ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ اِلاَّ بِالْمَقَائِسِ
অর্থ: (দলিল-প্রমাণের বিপক্ষে) সর্বপ্রথম যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগকারী হলো ইবলিস। আর যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করেই লোকেরা চন্দ্র সূর্যের উপাসনা করে।
আল্লামা ইবনে কাছির বলেন :
قَاسَ اِبْلِيْسُ قِيَاسًا فَاسِدًا فِىْ مُقَابَلَةِ النَّصِ
অর্থ: এভাবেই দলিল-প্রমাণ (evidence)-এর বিপক্ষে ইবলিস তার ভ্রান্ত যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে।১
৭.সে কুফুরির পথকে আঁকড়ে ধরে : শয়তান ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করে ভালোভাবেই এ জ্ঞান অর্জন করেছিল যে, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা মানেই কুফুরি। ফলে সে জেনে বুঝেই কুফুরির পথ অবলম্বন করে :
إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
অর্থ: তবে সাজদা করেনি ইবলিস। সে হঠকারিতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪ ; সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)
৮.সে নিজের ভ্রষ্টতার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে : শয়তানের সবচেয়ে বড়, জঘন্য ও ঘোরতর অপরাধ হলো, সে যে উপরোক্ত অপরাধগুলো সংঘটিত করে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করলো, এজন্যে সে নিজের অপরাধ স্বীকার না করে আল্লাহকে দায়ী করে (নাউযুবিল্লাহ) :
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ
অর্থ: সে বলে, যেহেতু তুমি আমাকে ভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছো, সে জন্যে আমিও এখন থেকে তাদের (আদম সন্তানদের) বিপথগামী করার জন্যে তোমার সিরাতুল মুস্তাকিম-এ ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬)
৯. চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত হলো শয়তান
এসব গুরুতর অপরাধের ফলে শয়তান চিরতরে অভিশপ্ত হলো এবং অনিবার্যভাবে সাব্যস্ত হলো জাহান্নামের জ্বালানি :
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : তুই এখান থেকে বের হয়ে যা, তুই ধিকৃত (outcust)। আর বিচার দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিশাপ (curse)। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৪-৩৫; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৭-৭৮)
সাথে সাথে তাকে একথাও বলে দেয়া হলো :
فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ
অর্থ : বেরিয়ে যা, এখন থেকে তুই নিচুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৩)
قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَّدْحُورًا
অর্থ : তিনি বললেন : তুই ওখান থেকে বেরিয়ে যা অপমানিত ও ধিকৃত হয়ে।’ (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)
১০. আদম সন্তানদের আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার অংগিকার
শয়তানকে চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত ঘোষণা করার পর সে চিরতরে নিরাশ হয়ে গেলো। কিন্তু সে নিজের অপরাধের জন্যে নত না হয়ে আরো ঔদ্ধত্যে মেতে উঠলো। সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে আদম এবং আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ (সুযোগ) প্রার্থনা করলো :
قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ
অর্থ : সে বললো : ‘পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন : যা তুই অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। (আল কুরআন, সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৪-১৫; সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৬-৩৭; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৯-৮০)
মহান আল্লাহ তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। আল্লাহ তার অবকাশ মঞ্জুর করার সাথে সাথে সে অংগিকার এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বললো :
فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
অর্থ : তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত) পাবেনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬-১৭)
قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ক্স إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
অর্থ : সে (ইবলিস) বললো : আপনার ক্ষমতার শপথ (By your might) আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, আপনার একান্ত অনুগত দাসদের ছাড়া। (আল কুরআন, সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৮২-৮৩)
ইবলিসের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাকে জানিয়ে দিলেন : তুই যাকে যাকে পারিস পদস্খলনের দিকে ডাক, অশ্বারোহী পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালা, ধন সম্পদ সন্তান সন্তুতিতে তাদের সাথে শরিক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেল- তোর সব প্রতিশ্রুতিই তো ধোকাবাজি আর প্রতারণা। জেনে রাখ :
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلاً
অর্থ : আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৫)
আল্লাহ শয়তানকে আরো বলে দিলেন :
لَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكُمْ أَجْمَعِينَ
অর্থ : আদম সন্তানদের মধ্যে যারাই তোর অনুসরণ করবে, তোর সাথে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্তি করবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)
মানুষকে বিপথগামী করার জন্যে শয়তানের কৌশল :
১.শয়তান মানুষের মনে কুপ্ররোচনা সৃষ্টি করে :
يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
অর্থ : সে (খান্নাস হয়ে) কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। (সূরা ১১৪ নাস : আয়াত ৫)
২.সে খান্নাসি কৌশল অবলম্বন করে :
مِنْ شَرِّ الْوَسْوَسِ الْخَنَّاسِ
অর্থ : ‘আমি আশ্রয় চাই খান্নাসের কুমন্ত্রণার ক্ষতি থেকে।’ অর্থাৎ সে এতোটা বদ যে, বারবার সামনে এসে কুমন্ত্রণা দেয় এবং পিছিয়ে যায়, বারবার প্রকাশ হয়ে কুমন্ত্রণা দেয় এবং গোপন হয়ে যায়। (সূরা ১১৪ আন্ নাস : আয়াত ৪)
৩.শয়তান মানুষকে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা আশা-বাসনা সৃষ্টি করে :
يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ ۖ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
অর্থ : সে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আসলে শয়তান তাদের যে ওয়াদা দেয় তা প্রতারণা মাত্র। (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ১২০)
৪.শয়তান মানুষের মন্দ কাজকে তাদের কাছে শোভনীয় ও মনোহরী (fair seeming) করে তোলে :
وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ
অর্থ : শয়তান তাদের মন্দ কাজসমূহকে তাদের দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহরী করে তোলে এবং এভাবে তাদের সরল সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। (সূরা ২৯ আনকাবুত : আয়াত ৩৮)
৫.মানুয যেনো দান না করে সেজন্যে শয়তান মানুষকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যে উদ্বুদ্ধ করে :
اَلشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ
অর্থ : শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কৃপণতার আদেশ করে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৬৮)
৬.শয়তান মানুষকে মাদক, জুয়া, আস্তানা এবং ভাগ্য নির্ণয়ের খেলায় লিপ্ত করে :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ : হে ঈমানওয়ালা লোকেরা! জেনে রাখো, মদ (মাদক), জুয়া, আস্তানা (বেদী), ভাগ্য নির্ণয়ের শর -এসবই শয়তানের নোংরা কর্ম। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন করো, সফলতা অর্জন করবে। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯০)
৭.শয়তান মানুষের মধ্যে পারস্পারিক শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে :
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
অর্থ: শয়তান মাদক ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। তবু কি তোমরা (এসব শয়তানি কর্ম থেকে) নিবৃত হবেনা। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯১)
৮.শয়তান সুদী কারবারে লিপ্ত করে :
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ
অর্থ: যারা সুদ খায়, তারা অবশ্যি ঐ ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য করে দিয়েছে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৭৫)
৯.শয়তান মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত করে :
وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ
অর্থ: কতক লোক এমন আছে যারা অজ্ঞতা নিয়ে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। (সূরা ২২ হজ্জ: আয়াত ৩)
১০.শয়তান মানুষকে অশ্লীল ও মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে :
وَمَن يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ
অর্থ: যে শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে, সে জেনে রাখুক, শয়তান অশ্লীল ও মন্দ কর্মের আদেশ দেয় (প্রলুব্ধ করে)। (সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ২১)
১১.যারা হিদায়াতের পথ দেখতে পেয়েও তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয় :
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى ۙ الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ
অর্থ: হিদায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ও প্রমাণিত হবার পর যারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদেরকে তাদের এ আচরণ শোভন ও চমৎকার করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা আকাংখায় লিপ্ত করে রাখে। (সূরা ৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত ২৫)
১২.শয়তান মানুষকে কানকথায় লিপ্ত করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় :
إِنَّمَا النَّجْوَىٰ مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوا
অর্থ: কানকানি ফিসফিসানি শয়তানের কাজ। সে এটা করায় মুমিনদের ব্যথিত করার জন্যে। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১০)
১৩.শয়তান মানুষের মন-মস্তিষ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয় :
اِسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ ۚ أُولَـٰئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ
অর্থ : শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে; এভাবে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর কথা। মূলত এরাই শয়তানের দলের লোক। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১৯)
১৪.শয়তান মানুষকে দিয়ে অপব্যয় এবং অপচয় করায় :
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
অর্থ: যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)
১৫.শয়তান মন্দ কাজে প্রবলভাবে প্রলুব্ধ করে :
أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا
অর্থ: তুমি কি লক্ষ্য করোনি, আমি কাফিরদের জন্যে শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি তাদেরকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করার জন্যে? (সূরা ১৯ মরিয়ম : আয়াত ৮৩)
আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন :
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
অর্থ: যখনই তুমি আল কুরআন অধ্যয়নের সংকল্প করবে, তখন ধিকৃত অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নিও। (সূরা আন নহল : আয়াত ৯৮)
শয়তান ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তার ভক্ত বন্ধুদের লেলিয়ে দেয়:
যেসব লোক ইসলামের প্রচলন, অনুসরণ ও বাস্তবায়নকে পছন্দ করেনা, শয়তান তাদের বন্ধু হয়ে যায়। সে তাদেরকে ইসলামের অনুসারীদের শত্র“তা ও বিরুদ্ধাচরণে উস্কে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন :
وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ
অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে (**) অহি করে (উস্কে দেয়)। আনুগত্য করো, তবে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১২১)
প্রত্যেক নবী ও তাঁর খাঁটি অনুসারীদের বিরুদ্ধেই জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান দুশমনিতে লিপ্ত হয়েছে। তারা পরস্পরকে নবী ও নবীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুশমনি করতে উস্কে দেয়, লেলিয়ে দেয় :
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
অর্থ: এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর বিরুদ্ধে মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের শত্রুতা করার অবকাশ দিয়েছি। তারা পরস্পরকে মনোহরী কথা বলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দেয়। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১১২)
১৭. শয়তান আল্লাহর নাফরমানি করিয়ে এবং হানাহানি বাধিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে:
শয়তান মানুষের বন্ধু ও কল্যাণকামী সেজে মানুষকে প্ররোচনা দেয়। আর শয়তানের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কেউ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে এবং অপরাধ সংঘটিত করে বসে, তখন শয়তান তাকে ফেলে কেটে পড়ে :
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ
অর্থ: তাদের উপমা হলো শয়তান। শয়তান মানুষকে (প্ররোচনা দিয়ে) বলে : ‘কুফুরি (আল্লাহর হুকুম অমান্য) করো।’ অতপর সে যখন কুফুরি করে বসে, তখন শয়তান তাকে বলে : ‘তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই, আমি তো আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে ভয় করি।’ ফলে উভয়ের পরিণতিই হবে জাহান্নাম। (সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ১৬-১৭)
শয়তান কিভাবে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ ও হানাহানি উস্কে দিয়ে কেটে পড়ে, কুরআন মজিদে আরেক স্থানে মহান আল্লাহ সেকথা এভাবে উল্লেখ করেছেন :
وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ ۖ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ ۚ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
অর্থ: স্মরণ �
সূত্র: ফেসবুক ।
কিন্তু মানুষ তার এই স্বঘোষিত সুস্পষ্ট শত্রুর বিষয়ে অচেতন, অসতর্ক ও গাফিল। যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা নবী রসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে শয়তান সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন।
ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ
‘তারপর আমি তাকে নামিয়ে দিই নিচুদের চাইতেও নিচে।’ (সূরা আত তীন : ৫)
শয়তানের পদাংক অনুসরণ না করতে, তার আনুগত্য ও দাসত্ব না করতে :
يَا بَنِي آدَمَ لاَ يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُم مِّنَ الْجَنَّةِ يَنزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا ۗ إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ ۗ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
অর্থ : হে আদম সন্তানেরা (সতর্ক হও)! শয়তান যেনো ধোকা প্রতারণার (ফবপবরাব) মাধ্যমে তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন থেকে বিচ্যুত করে) ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, যেভাবে সে (ধোকা প্রতারণার মাধ্যমে) তোমাদের (আদি) পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছিল। তাদের পরস্পরকে তাদের গোপন অংগ দেখানোর জন্যে সে তাদের বিবস্ত্র করে দিয়েছিল। সে এবং তার দলবল এমনভাবে (বা এমন স্থান থেকে) তোমাদের দেখতে পায় যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাওনা। আমি শয়তানগুলোকে সেই সব লোকদের অলি (অভিভাবক) বানিয়ে দিয়েছি, যারা ঈমান আনেনা, ঈমানের পথে চলেনা। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ২৭)
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
অর্থ : তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই সে তোমাদের ডাহা দুশমন। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ১৬৮)
وَلَا يَصُدَّنَّكُمُ الشَّيْطَانُ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ
অর্থ : (হে মানুষ!) শয়তান যেনো (সত্য-সঠিক-সরল পথে চলতে) তোমাদের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে না পারে। জেনে রাখো, সে তোমাদের সুস্পষ্ট শত্রু। (সূরা ৪৩ যুখরুফ : আয়াত ৬২)
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا ۖ وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ
عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوًّا ۚ إِنَّمَا يَدْعُو حِزْبَهُ لِيَكُونُوا مِنْ أَصْحَابِ السَّعِيرِ
অর্থ : হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা হক (সত্য); সুতরাং এই পৃথিবীর জীবন যেনো কিছুতেই তোমাদের প্রলুব্ধ ও প্রতারিত না করে এবং সেই মহা প্রতারক (শয়তান)ও যেনো আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের ধোকায় না ফেলে। শয়তান তো তোমাদের ডাহা শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার অনুসারীদের (এমন সব কাজের) আহবান জানায়, যাতে তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়ে যায়। (সূরা ৩৫ ফাতির : আয়াত ৫-৬)
মহান আল্লাহ এসব অকাট্য ও বিবেক জাগ্রতকারী সতর্কবাণী দ্বারা কি মানুষ শয়তানের ধোকা, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেনা?
২.শয়তান আল্লাহর অবাধ্য, মানুষের চরম দুশমন এবং মহাপ্রতারক
শয়তান সম্পর্কে মানুষের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। কারণ যে ব্যক্তি শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেনা, সে সহজেই শত্রুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। দেখুন শয়তান সম্পর্কে মহান আল্লাহ কী বলেন :
১. শয়তান আল্লাহর চরম অবাধ্য : إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَـٰنِ عَصِيًّا ‘শয়তান দয়াময় রহমানের চরম অবাধ্য-নাফরমান।’ (সূরা মরিয়ম : আ. ৪৪)
২.শয়তান আল্লাহর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا ‘শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)
৩.শয়তান মানুষের স্বঘোষিত সুস্পষ্ট দুশমন : ِاِنَّ الشَّيْطَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوٌّ مُّبِينٌ ‘নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের সুস্পষ্ট শত্রু।’ (সূরা ১২ ইউসুফ : আয়াত ৫)
৪.শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক : وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًا ‘অবশ্যি শয়তান মানুষের জন্যে মহাপ্রবঞ্চক, মহা ধোকাবাজ।’ (সূরা ২৫: ২৯)
৫.শয়তান মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায় : إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ
‘এ হলো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়।’ (সূরা ৩ : ১৭৫)
৬.শয়তানের সংকল্প মানুষকে চরম বিপথগামী করা : وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا : ‘শয়তান তাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে বহুদূর নিয়ে যেতে চায়।’ (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ৬০)
৭.মানুষের সামনে শয়তানের সব প্রতিশ্রুতিই প্রতারণা : وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا : ‘শয়তানের সমস্ত ওয়াদাই প্রতারণা আর ধোকাবাজি।’ (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৪)
৮.শয়তান মহাপ্রতারক : وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغُرُوْرَ ‘মহাপ্রতারক যেনো আল্লাহর ব্যাপারে তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে। (সূরা লোকমান : ৩৩ ; সূরা ফাতির : ৫)
৩. শয়তানের পরিচয়
আরবি ভাষায় শয়তান (شَيْطَانٌ) মানে- সীমালংঘনকারী, দাম্ভিক, স্বৈরাচারি।১ এই বৈশিষ্ট্যের জিন এবং মানুষ উভয়ের জন্যেই শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কুরআন মজিদে উভয়ের জন্যে শয়তান পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে ইসলামের বিরুদ্ধাচারী নেতাদের শয়তান বলা হয়েছে। شَيْطَانٌ-এর বহুবচন شَيَاطِيْنٌ। শয়তান শব্দটি একটি পরিভাষা হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই সকল ধর্মের লোকদের কাছে একটি সুপরিচিত শব্দ। এ শয়তান জিনদের অন্তরভুক্ত২। শয়তান কথাটি সর্বপ্রথম সেই জিনটির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, যে আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করে প্রথম মানুষ আদম আলাইহিস্ সালামকে সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়। কুরআন মজিদে শয়তান শব্দটি একবচন ও বহুবচনে ৮৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
শয়তানকে কুরআন মজিদে ইবলিসও বলা হয়েছে।৩ بَلَسٌ ও اِبْلاَسٌ শব্দমূল থেকে اِبْلِيْسٌ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া, ভয়ে ও আতংকে নিথর হয়ে যাওয়া, দু:খে ও শোকে মনমরা হয়ে যাওয়া, সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশা ও ব্যর্থতার ফলে মরিয়া (desperate) হয়ে উঠা।
শয়তানকে ইবলিস বলার কারণ হলো, হতাশা ও নিরাশার ফলে তার আহত অহমিকা প্রবল উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মরণ খেলায় নেমে সব ধরণের অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হয়।৪ কুরআন মজিদে ইবলিস শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১১ বার।
শয়তানকে কুরআন মজিদে খান্নাসও বলা হয়েছে।৫ خَنَّاسٌ শব্দটি خُنُوْسٌ শব্দমূল থেকে নির্গত হয়েছে। এর অর্থ- সামনে এসে আবার পিছিয়ে যাওয়া, প্রকাশ হয়ে আবার গোপন হয়ে যাওয়া। খান্নাস আধিক্যবোধক শব্দ। সুতরাং এর অর্থ বারবার সামনে আসা এবং পিছিয়ে যাওয়া, বারবার প্রকাশ হওয়া এবং গোপন হয়ে যাওয়া।
শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে এ কারণে যে, সে বারবার এসে প্ররোচনা দেয় এবং বারবার পিছিয়ে এবং লুকিয়ে যায়। এভাবে সে প্ররোচনা দিতেই থাকে। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : মানুষ যখন গাফিল ও অসতর্ক-অসচেতন হয়, তখনই শয়তান এসে তাকে প্ররোচনা ও ধোকা দেয়; কিন্তু যখনই সে সতর্ক হয় এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান পিছিয়ে যায়, লুকিয়ে যায়। এ কারণেই শয়তানকে খান্নাস বলা হয়েছে।৬ কুরআন মজিদে খান্নাস শব্দ ব্যবহার হয়েছে ১ বার।
কুরআন মজিদে শয়তানকে আল গারুর (اَلْغَرُوْرٌ)ও বলা হয়েছে। এর শব্দমূল হলো গরর (غَرَرٌ)। গরর মানে- ধোকা-প্রতারণা। আল গারূর মানে- মহা ধোকাবাজ, মহাপ্রতারক। কুরআন মজিদে ৩ স্থানে শয়তানকে আল গারূর বলা হয়েছে।
৪.শয়তানের পূর্ব ইতিহাস
কুরআন মজিদের সূরা কাহাফের ৫০ (পঞ্চাশ) নম্বর আয়াতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, ইবলিস শয়তান জিন গোত্রীয়। আর জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন থেকে। সুতরাং শয়তান আগুনের তৈরি জিন জাতির অন্তর্ভুক্ত।
মুফাস্সির এবং ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারি এবং ইবনে কাছির তাঁদের তফসির এবং ইতিহাস গ্রন্থাবলীতে সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. , ইবনে মাসউদ রা. এবং তাবেয়ী হাসান বসরি, তাউস, সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যেব, সা’দ ইবনে মাসউদ, শহর ইবনে হোশেব, কাতাদা প্রমুখ থেকে শয়তান ইবলিসের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত সার হলো :
মানুষের পূর্বে আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো জিন জাতি। তারা ছিলো আগুনের তৈরি এবং দীর্ঘজীবী। একসময় এসে তারা পারস্পারিক বিবাদ বিসম্বাদে পৃথিবীকে চরম বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের দুষ্কর্মে ও ফিতনা ফাসাদে ভরে যায় পৃথিবী। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরেশতাদের পাঠান তাদের কর্তৃত্ব ধ্বংস করতে এবং তাদের বিতাড়িত করতে। ফেরেশতারা এসে জিনদের একদলকে ধ্বংস করে দেন, কিছু জিনকে সমুদ্রের দিকে তাড়িয়ে দেন আর কিছু জিনকে তাড়িয়ে দেন পাহাড় পর্বতের দিকে। এভাবে মহান আল্লাহ পৃথিবী পরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে জিনদের উচ্ছেদ করেন এবং তাদের কর্তৃত্বের ক্ষমতা বিনাশ করে দেন।
এই ফেরেশতাদল পৃথিবী থেকে ফিরে যাবার সময় আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে একটি জিন শিশুকে সাথে করে নিয়ে যায়। তার নাম ছিলো আযাযিল। সে ফেরেশতাদের সাথে বসবাস করতে থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের গুণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এভাবে সে ফেরেশতাদের সাথে মিশে যায়। পরবর্তীকালে এই আযাযিলই শয়তান এবং ইবলিস হিসেবে পরিচিত হয়।৭
৫.ইবলিস আল্লাহর হুকুম সত্ত্বেও আদমকে সাজদা করেনি
পৃথিবী থেকে জিনদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করার পর মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন :
إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً
অর্থ : আমি পৃথিবীতে (নতুন করে) প্রতিনিধি/আরেকটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩০)
অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ একটি নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করার মনস্থ করলেন। এ প্রজাতির নাম দিলেন তিনি ‘মানুষ’।র প্রতিনিধিত্ব করার সব জ্ঞান দান করলেন তিনি আদমকে। পৃথিবীর প্রতিনিধিত্বের কর্তৃত্ব পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন ফেরেশতাদের সহযোগিতা। তাই মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের হুকুম করলেন আদমকে সাজদা করতে। অর্থাৎ আদম ও তার সন্তানদের আনুগত্য করার প্রতীকি প্রমাণ পেশ করতে। ফেরেশতারা সবাই আদমকে সাজদা করে। কিন্তু সাজদা করতে অস্বীকৃতি জানায় ইবলিস :
ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِيْن
অর্থ : অতপর আমরা ফেরেশতাদের বললাম : ‘আদমের উদ্দেশ্যে সাজদা করো।’ তখন সবাই সাজদা করলো ইবলিস ছাড়া। সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলোনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১১)
وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ
অর্থ : আমরা যখন ফেরেশতাদের আদেশ করলাম : ‘তোমরা সাজদা করো আদমকে।’ তখন সাজদা করলো সবাই; ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ০২ আল বাকরা : আয়াত ৩৪; সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১; সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)
فَسَجَدَ الْمَلَائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلَّا إِبْلِيسَ
অর্থ : তখন সাজদা করলো ফেরেশতারা সকলেই ইবলিস্ ছাড়া। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩০-৩১; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৩-৭৪)
আল্লাহ ইবলিসকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা থেকে বিরত রেখেছে?
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ : সে বললো : আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। (সূরা ৭ আল আ’রাফ : আয়াত ১২)
.মহান আল্লাহ ইবলিসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে সহই ফেরেশতাদের সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাইতো সাজদা না করার কারণে তিনি ইবলিসকে প্রশ্ন করলেন :
قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : (হে ইবলিস) আমি নির্দেশ দেয়া সত্তেও কোন্ জিনিস তোমাকে সাজদা করা থেকে বিরত রেখেছে? (সূরা ৭ আল আরাফ : আয়াত ১২)
قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا لَكَ أَلَّا تَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
অর্থ আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস ! তোমার কী হলো যে, তুমি সাজদা কারীদের অন্তর্ভুক্ত হলেনা? (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩২)
قَالَ يَا إِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ۖ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنتَ مِنَ الْعَالِينَ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : হে ইবলিস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি , তাকে সাজদা করতে কিসে তোমাকে বাধা দিলো? তুমি কি ঔদ্ধত্য দেখালে, নাকি তুমি উচু মর্যাদার কেউ? (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৫)
এখন একথা পরিষ্কার হয়ে গেলো, মহান আল্লাহ ইবলিসকে সহই ফেরেশতাদেরকে সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তা না হলে ইবলিসের কাছে সাজদা না করার কৈফিয়ত তলব করার কোনো কারণ ছিলনা।
২.দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইবলিসকে সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত প্রমাণ করে, সেটা হলো স্বয়ং ইবলিসের স্বীকৃতি এবং অস্বীকৃতি।
অর্থাৎ এ নির্দেশ যে ইবলিসের উপরও বর্তিয়েছিল, সেটা ইবলিস নিজেও স্বীকার করে নিয়েছিল। সে আল্লাহর কৈফিয়ত তলবের জবাবে একথা বলে নাই যে, নির্দেশ তো আমাকে দেন নাই, দিয়েছেন ফেরেশতাদেরকে।
তাছাড়া নির্দেশ পালনে তার অস্বীকৃতিও প্রমান করে যে, তাকেও সাজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে আল্লাহর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায় এবং যুক্তি প্রদর্শন করে। দেখুন আল্লাহ্র কৈফিয়ত তলবের জবাবে তার বক্তব্য :
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ ۖ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ : সে (জবাবে) বললো : (আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা, কারণ) আমি তার চাইতে উত্তম-শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন দিয়ে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে। (সূরা ৭ আ’রাফ: আয়াত ১২; সুরা ৩৮ সোয়াদ: আয়াত ৭৬)
قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا ؟
অর্থ : (জবাবে ইবলিস) বললো : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দিয়ে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)
قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
অর্থ : সে বললো : গন্ধযুক্ত কাদার ঠনঠনে মাটি দিয়ে আপনি যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে সাজদা করতে পারিনা। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৩)
এখন একথা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে গেলো, ইবলিস কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই একেবারে সহজ সরলভাবে বুঝে নিয়েছিল, সেও সাজদা করার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সুতরাং যার ব্যাপারে প্রশ্ন, তারই যখন কোনো প্রশ্ন নেই, তখন আমি আপনি প্রশ্ন তোলার কে?
৭. ইবলিস জেনে বুঝেই আল্লাহর হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে
একথা পরিষ্কার, ইবলিসও সাজদা করার হুকুমের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। জেনে বুঝেই সে আল্লাহর আদেশ পালন করেনি এবং আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তার এই অস্বীকৃতির ধরণ কেমন ছিলো? এ প্রসঙ্গে দেখুন আল্লাহর বাণী :
أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
অর্থ : সে (আল্লাহ্র নির্দেশমতো আদমকে সাজদা করতে) অস্বীকৃতি জানায়, অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ৩৪; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪)
أَبَىٰ أَن يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِينَ
অর্থ : সে সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে। (সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩১)
كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
অর্থ : সে ছিলো জিন প্রজাতির। সে তার প্রভুর নির্দেশ মান্য করতে অস্বীকার করে এবং সীমালংঘন করে। (সূরা ১৮ আল কাহাফ : আয়াত ৫০)
এখানে ইবলিসের সাজদা না করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি, অহংকার-দাম্ভিকতা, কুফুরি এবং সীমালংঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জেনে বুঝে হুকুম অমান্য করার ক্ষেত্রেই এ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৮. শয়তানের গুরুতর অপরাধ সমূহ
আদমকে সাজদা করার ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে শয়তান তার মর্যাদার আসনে থেকে এমন সব গুরুতর অপরাধ করে বসলো, যা চরম অমার্জিত ও ক্ষমাহীন। তার সেই গুরুতর অপরাধ সমূহ হলো :
১.সে আল্লাহ্র হুকুম পালন করতে অস্বীকার করে এবং
২.সে অহংকার, দাম্ভিকতা ও হঠকারীতা প্রদর্শন করে :
أَبَىٰ وَاسْتَكْبَرَ
অর্থ : সে আল্লাহর আদেশ পালন করতে অস্বীকার (refuse) করে, অহংকার-দাম্ভিকতা-হঠকারিতা প্রদর্শন করে। (সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)
৩.সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে এবং অবাধ্য হয় :
فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ
অর্থ : সে তার প্রভুর হুকুম অমান্য করে সীমালংঘন করে । (সূরা ১৮ কাহাফ : ৫০)
৪.সে নিজেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে :
قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ
অর্থ : সে বলে : আমি তার (আদমের) চাইতে শ্রেষ্ঠ। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)
৫.সে অনুশোচনা করেনি; বরং নিজের হঠকারিতার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে :
قَالَ أَأَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِينًا
অর্থ : সে বলে : আমি কি এমন একজনকে সাজদা করবো, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে? (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬১)
নিজের অবাধ্যতার পক্ষে সে আরো যুক্তি প্রদর্শন করে :
خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ
অর্থ: তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছো কাদামাটি থেকে। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১২)
قَالَ لَمْ أَكُن لِّأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُونٍ
অর্থ: সে বলে : মানুষকে সাজদা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যাকে তুমি সৃষ্টি করেছো শুকনো ঠনঠনে পঁচা মাটি থেকে। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৩)
৬.সে আল্লাহ্র হুকুমের বিপক্ষে যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে : আল্লামা ইবনে জারির তাবারি এবং আল্লামা ইবনে কাছির তাঁদের তফসিরে উল্লেখ করেছেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী মুফাস্সির হাসান বসরি রহ. বলেছেন :
قَاسَ اِبْلِيْسُ وَهُوَ اَوَّلَ مَنْ قَاسَ
অর্থ: ইবলিস তার যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে (নিজেকে শ্রেষ্ঠ ধারণা করে) এবং ইবলিসই সর্বপ্রথম দলিল (evidence)-এর বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে।
প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে সীরিন বলেন :
اَوَّلَ مَنْ قَاسَ اِبْلِيْسُ وَمَا عَبَدَتِ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ اِلاَّ بِالْمَقَائِسِ
অর্থ: (দলিল-প্রমাণের বিপক্ষে) সর্বপ্রথম যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগকারী হলো ইবলিস। আর যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করেই লোকেরা চন্দ্র সূর্যের উপাসনা করে।
আল্লামা ইবনে কাছির বলেন :
قَاسَ اِبْلِيْسُ قِيَاسًا فَاسِدًا فِىْ مُقَابَلَةِ النَّصِ
অর্থ: এভাবেই দলিল-প্রমাণ (evidence)-এর বিপক্ষে ইবলিস তার ভ্রান্ত যুক্তি বুদ্ধি প্রয়োগ করে।১
৭.সে কুফুরির পথকে আঁকড়ে ধরে : শয়তান ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করে ভালোভাবেই এ জ্ঞান অর্জন করেছিল যে, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা মানেই কুফুরি। ফলে সে জেনে বুঝেই কুফুরির পথ অবলম্বন করে :
إِلَّا إِبْلِيسَ اسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ
অর্থ: তবে সাজদা করেনি ইবলিস। সে হঠকারিতা প্রদর্শন করে এবং কাফিরদের অন্তরভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৪ ; সূরা ২ বাকারা : আয়াত ৩৪)
৮.সে নিজের ভ্রষ্টতার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে : শয়তানের সবচেয়ে বড়, জঘন্য ও ঘোরতর অপরাধ হলো, সে যে উপরোক্ত অপরাধগুলো সংঘটিত করে ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করলো, এজন্যে সে নিজের অপরাধ স্বীকার না করে আল্লাহকে দায়ী করে (নাউযুবিল্লাহ) :
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ
অর্থ: সে বলে, যেহেতু তুমি আমাকে ভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছো, সে জন্যে আমিও এখন থেকে তাদের (আদম সন্তানদের) বিপথগামী করার জন্যে তোমার সিরাতুল মুস্তাকিম-এ ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬)
৯. চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত হলো শয়তান
এসব গুরুতর অপরাধের ফলে শয়তান চিরতরে অভিশপ্ত হলো এবং অনিবার্যভাবে সাব্যস্ত হলো জাহান্নামের জ্বালানি :
قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ
وَإِنَّ عَلَيْكَ اللَّعْنَةَ إِلَىٰ يَوْمِ الدِّينِ
অর্থ : আল্লাহ বললেন : তুই এখান থেকে বের হয়ে যা, তুই ধিকৃত (outcust)। আর বিচার দিবস পর্যন্ত তোর উপর অভিশাপ (curse)। (সূরা ১৫ আল হিজর : আয়াত ৩৪-৩৫; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৭-৭৮)
সাথে সাথে তাকে একথাও বলে দেয়া হলো :
فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِينَ
অর্থ : বেরিয়ে যা, এখন থেকে তুই নিচুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৩)
قَالَ اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُومًا مَّدْحُورًا
অর্থ : তিনি বললেন : তুই ওখান থেকে বেরিয়ে যা অপমানিত ও ধিকৃত হয়ে।’ (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)
১০. আদম সন্তানদের আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করার অংগিকার
শয়তানকে চিরতরে ধিকৃত ও অভিশপ্ত ঘোষণা করার পর সে চিরতরে নিরাশ হয়ে গেলো। কিন্তু সে নিজের অপরাধের জন্যে নত না হয়ে আরো ঔদ্ধত্যে মেতে উঠলো। সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা না করে আদম এবং আদম সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ (সুযোগ) প্রার্থনা করলো :
قَالَ أَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ قَالَ إِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ
অর্থ : সে বললো : ‘পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও।’ তিনি (আল্লাহ) বললেন : যা তুই অবকাশ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। (আল কুরআন, সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৪-১৫; সূরা ১৫ হিজর : আয়াত ৩৬-৩৭; সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৭৯-৮০)
মহান আল্লাহ তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। আল্লাহ তার অবকাশ মঞ্জুর করার সাথে সাথে সে অংগিকার এবং চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বললো :
فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
অর্থ : তুমি যেমন আমাকে বিপথগামী করেছো, তেমনি আমিও এখন থেকে তাদের (আদম ও তার সন্তানদের বিপথগামী করার জন্যে) তোমার সিরাতুল মুস্তাকিমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে সবদিক থেকে তাদের ঘেরাও করে নেবো। ফলে তাদের অধিকাংশকেই তুমি কৃতজ্ঞ (তোমার অনুগত) পাবেনা। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৬-১৭)
قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَأُغْوِيَنَّهُمْ أَجْمَعِينَ ক্স إِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِينَ
অর্থ : সে (ইবলিস) বললো : আপনার ক্ষমতার শপথ (By your might) আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, আপনার একান্ত অনুগত দাসদের ছাড়া। (আল কুরআন, সূরা ৩৮ সোয়াদ : আয়াত ৮২-৮৩)
ইবলিসের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ তাকে জানিয়ে দিলেন : তুই যাকে যাকে পারিস পদস্খলনের দিকে ডাক, অশ্বারোহী পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালা, ধন সম্পদ সন্তান সন্তুতিতে তাদের সাথে শরিক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেল- তোর সব প্রতিশ্রুতিই তো ধোকাবাজি আর প্রতারণা। জেনে রাখ :
إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ ۚ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ وَكِيلاً
অর্থ : আমার প্রকৃত দাসদের উপর তোর কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবেনা। (হে মুহাম্মদ!) ভরসা করার জন্যে তোমার প্রভুই যথেষ্ট। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ৬৫)
আল্লাহ শয়তানকে আরো বলে দিলেন :
لَمَن تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكُمْ أَجْمَعِينَ
অর্থ : আদম সন্তানদের মধ্যে যারাই তোর অনুসরণ করবে, তোর সাথে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভর্তি করবো। (সূরা ৭ আ’রাফ : আয়াত ১৮)
মানুষকে বিপথগামী করার জন্যে শয়তানের কৌশল :
১.শয়তান মানুষের মনে কুপ্ররোচনা সৃষ্টি করে :
يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
অর্থ : সে (খান্নাস হয়ে) কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। (সূরা ১১৪ নাস : আয়াত ৫)
২.সে খান্নাসি কৌশল অবলম্বন করে :
مِنْ شَرِّ الْوَسْوَسِ الْخَنَّاسِ
অর্থ : ‘আমি আশ্রয় চাই খান্নাসের কুমন্ত্রণার ক্ষতি থেকে।’ অর্থাৎ সে এতোটা বদ যে, বারবার সামনে এসে কুমন্ত্রণা দেয় এবং পিছিয়ে যায়, বারবার প্রকাশ হয়ে কুমন্ত্রণা দেয় এবং গোপন হয়ে যায়। (সূরা ১১৪ আন্ নাস : আয়াত ৪)
৩.শয়তান মানুষকে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা আশা-বাসনা সৃষ্টি করে :
يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ ۖ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا
অর্থ : সে প্রতিশ্র“তি দেয় এবং মানুষের মনে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করে। আসলে শয়তান তাদের যে ওয়াদা দেয় তা প্রতারণা মাত্র। (সূরা ৪ আন নিসা : আয়াত ১২০)
৪.শয়তান মানুষের মন্দ কাজকে তাদের কাছে শোভনীয় ও মনোহরী (fair seeming) করে তোলে :
وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ
অর্থ : শয়তান তাদের মন্দ কাজসমূহকে তাদের দৃষ্টিতে চমৎকার ও মনোহরী করে তোলে এবং এভাবে তাদের সরল সঠিক পথ অবলম্বনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। (সূরা ২৯ আনকাবুত : আয়াত ৩৮)
৫.মানুয যেনো দান না করে সেজন্যে শয়তান মানুষকে দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং কার্পণ্যে উদ্বুদ্ধ করে :
اَلشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ
অর্থ : শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং কৃপণতার আদেশ করে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৬৮)
৬.শয়তান মানুষকে মাদক, জুয়া, আস্তানা এবং ভাগ্য নির্ণয়ের খেলায় লিপ্ত করে :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ : হে ঈমানওয়ালা লোকেরা! জেনে রাখো, মদ (মাদক), জুয়া, আস্তানা (বেদী), ভাগ্য নির্ণয়ের শর -এসবই শয়তানের নোংরা কর্ম। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন করো, সফলতা অর্জন করবে। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯০)
৭.শয়তান মানুষের মধ্যে পারস্পারিক শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে :
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
অর্থ: শয়তান মাদক ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং আল্লাহর স্মরণ ও সালাত আদায়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়। তবু কি তোমরা (এসব শয়তানি কর্ম থেকে) নিবৃত হবেনা। (সূরা ৫ আল মায়িদা : আয়াত ৯১)
৮.শয়তান সুদী কারবারে লিপ্ত করে :
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ
অর্থ: যারা সুদ খায়, তারা অবশ্যি ঐ ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধি শূন্য করে দিয়েছে। (সূরা ২ আল বাকারা : আয়াত ২৭৫)
৯.শয়তান মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত করে :
وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ
অর্থ: কতক লোক এমন আছে যারা অজ্ঞতা নিয়ে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের। (সূরা ২২ হজ্জ: আয়াত ৩)
১০.শয়তান মানুষকে অশ্লীল ও মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে :
وَمَن يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ
অর্থ: যে শয়তানের পদাংক অনুসরণ করে, সে জেনে রাখুক, শয়তান অশ্লীল ও মন্দ কর্মের আদেশ দেয় (প্রলুব্ধ করে)। (সূরা ২৪ আন নূর : আয়াত ২১)
১১.যারা হিদায়াতের পথ দেখতে পেয়েও তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা দেয় :
إِنَّ الَّذِينَ ارْتَدُّوا عَلَىٰ أَدْبَارِهِم مِّن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى ۙ الشَّيْطَانُ سَوَّلَ لَهُمْ وَأَمْلَىٰ لَهُمْ
অর্থ: হিদায়াত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ও প্রমাণিত হবার পর যারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, শয়তান তাদেরকে তাদের এ আচরণ শোভন ও চমৎকার করে দেখায় এবং তাদেরকে মিথ্যা আশা আকাংখায় লিপ্ত করে রাখে। (সূরা ৪৭ মুহাম্মদ : আয়াত ২৫)
১২.শয়তান মানুষকে কানকথায় লিপ্ত করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় :
إِنَّمَا النَّجْوَىٰ مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوا
অর্থ: কানকানি ফিসফিসানি শয়তানের কাজ। সে এটা করায় মুমিনদের ব্যথিত করার জন্যে। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১০)
১৩.শয়তান মানুষের মন-মস্তিষ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয় :
اِسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَأَنسَاهُمْ ذِكْرَ اللَّهِ ۚ أُولَـٰئِكَ حِزْبُ الشَّيْطَانِ
অর্থ : শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে; এভাবে সে তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর কথা। মূলত এরাই শয়তানের দলের লোক। (সূরা ৫৮ মুজাদালা : আয়াত ১৯)
১৪.শয়তান মানুষকে দিয়ে অপব্যয় এবং অপচয় করায় :
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
অর্থ: যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রভুর প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা ১৭ ইসরা : আয়াত ২৭)
১৫.শয়তান মন্দ কাজে প্রবলভাবে প্রলুব্ধ করে :
أَلَمْ تَرَ أَنَّا أَرْسَلْنَا الشَّيَاطِينَ عَلَى الْكَافِرِينَ تَؤُزُّهُمْ أَزًّا
অর্থ: তুমি কি লক্ষ্য করোনি, আমি কাফিরদের জন্যে শয়তানদের ছেড়ে রেখেছি তাদেরকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করার জন্যে? (সূরা ১৯ মরিয়ম : আয়াত ৮৩)
আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন :
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
অর্থ: যখনই তুমি আল কুরআন অধ্যয়নের সংকল্প করবে, তখন ধিকৃত অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নিও। (সূরা আন নহল : আয়াত ৯৮)
শয়তান ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তার ভক্ত বন্ধুদের লেলিয়ে দেয়:
যেসব লোক ইসলামের প্রচলন, অনুসরণ ও বাস্তবায়নকে পছন্দ করেনা, শয়তান তাদের বন্ধু হয়ে যায়। সে তাদেরকে ইসলামের অনুসারীদের শত্র“তা ও বিরুদ্ধাচরণে উস্কে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন :
وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ
অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে (**) অহি করে (উস্কে দেয়)। আনুগত্য করো, তবে অবশ্যি তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১২১)
প্রত্যেক নবী ও তাঁর খাঁটি অনুসারীদের বিরুদ্ধেই জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান দুশমনিতে লিপ্ত হয়েছে। তারা পরস্পরকে নবী ও নবীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুশমনি করতে উস্কে দেয়, লেলিয়ে দেয় :
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
অর্থ: এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর বিরুদ্ধে মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানদের শত্রুতা করার অবকাশ দিয়েছি। তারা পরস্পরকে মনোহরী কথা বলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে লেলিয়ে দেয়। (সূরা ৬ আল আনআম : আয়াত ১১২)
১৭. শয়তান আল্লাহর নাফরমানি করিয়ে এবং হানাহানি বাধিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে:
শয়তান মানুষের বন্ধু ও কল্যাণকামী সেজে মানুষকে প্ররোচনা দেয়। আর শয়তানের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে কেউ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে এবং অপরাধ সংঘটিত করে বসে, তখন শয়তান তাকে ফেলে কেটে পড়ে :
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ
অর্থ: তাদের উপমা হলো শয়তান। শয়তান মানুষকে (প্ররোচনা দিয়ে) বলে : ‘কুফুরি (আল্লাহর হুকুম অমান্য) করো।’ অতপর সে যখন কুফুরি করে বসে, তখন শয়তান তাকে বলে : ‘তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই, আমি তো আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে ভয় করি।’ ফলে উভয়ের পরিণতিই হবে জাহান্নাম। (সূরা ৫৯ হাশর : আয়াত ১৬-১৭)
শয়তান কিভাবে পরস্পরের মধ্যে বিবাদ ও হানাহানি উস্কে দিয়ে কেটে পড়ে, কুরআন মজিদে আরেক স্থানে মহান আল্লাহ সেকথা এভাবে উল্লেখ করেছেন :
وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَّكُمْ ۖ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ إِنِّي أَرَىٰ مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ ۚ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
অর্থ: স্মরণ �
সূত্র: ফেসবুক ।
No comments:
Post a Comment